বাংলা সাহিত্যের বই পড়ে অথচ ফেলুদা পড়েনি, এমন বাঙ্গালীকে প্রখর রৌদের দুপুরে সার্চলাইট দিয়ে খুঁজলেও পাওয়া যাবেনা।
সত্যজিৎ রায়ের এক অপুর্ব কর্ম ফেলুদা। বাংলা সাহিত্যে খুব কম লেখা আছে যেগুলো অনূদিত হয়েছে একাধিক ভাষায়। ফেলুদা গল্পগুলো সেই অল্প কয়টা লেখার একটা।
যারা পড়তে জানেনা তারাও ফেলুদাকে চেনে। কারন সত্যজিৎ রায় বেঁচে থাকতে ফেলুদা গল্প নিয়ে নিজেই দুটো চলচিত্র বানিয়েছিলেন। তারপর তাঁর ছেলে সন্দীপ রায় দশটি গল্প নিয়ে টেলিভিশন সিরিজ ‘ফেলুদা ৩০’ এবং আরও পাঁচটি গল্প নিয়ে চলচিত্র তৈরি করেছেন। ফলে পাড়াগাঁয়ের অক্ষরহীন মানুষটাও ফেলুদার নাম শুনলে বুঝতে পারে যে গোয়েন্দা ফেলু মিত্তিরের কথা বলা হচ্ছে।
কিন্তু আজকের এই ফেলুদা শুধু তোপশে কে নিয়েই ‘ফেলুদা’ হতে পারেনি। ফেলুদা গল্পগুলোকে ছোটবড় সবাই আপন করে নেয়ার পেছনে রহস্য-রোমাঞ্চ উপন্যাসিক লালমোহন গাঙ্গুলি ওরফে জটায়ুর ভুমিকা এক বাক্যে সবাই স্বীকার করবে। নির্লোভ এই মানুষটা তাঁর হাস্যরস, বোকামি আর সরলতা দিয়ে সবার মনেই এমন একটা জায়গা করে নিয়েছেন যে, তাঁর উপস্থিতি ছাড়া ফেলুদা গল্প পড়ে ভালই লাগেনা যেন কারও।
এবার মূলকথায় চলে আসি।
মানুষের মধ্যে একটা ধারনা আছে যে যিনিই জটায়ু চরিত্রে অভিনয় করেন তিনিই কয়দিন পর মারা যান। মানুষের এই ধারনাটার যে কোন শক্ত কারন নেই তা কিন্তু নয়।
সত্যজিৎ রায় ‘সোনার কেল্লা’ আর ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ গল্প নিয়ে দুটো চলচিত্র তৈরি করেছিলেন। দুটো চলচিত্রেই জটায়ু চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন সন্তোষ দত্ত।
খুব বেশি বয়স হয়নি তাঁর। দুটো চলচিত্র করার পরেই সন্তোষ দত্ত মারা যান।
জটায়ু চরিত্রে সন্তোষ দত্ত ছাড়া আর কাউকেই উপযুক্ত মনে হয়নি সত্যজিৎ রায়ের কাছে। তাই ‘জটায়ু’ মারা যাওয়াতে ফেলুদা নিয়ে আর কোন চলচিত্র বানাবেন না বলে ঘোষণা দেন তিনি।
কিন্তু সব্যসাচী চক্রবর্তী (দ্বিতীয় ফেলুদা) খুব অনুরোধ করেন সত্যজিৎ রায়কে চলচিত্র বানিয়ে যেতে। এক বাক্যে না করে দেন সত্যজিৎ রায়। কারন হিসেবে সন্তোষ দত্তর মৃত্যুর কথাই সব্যসাচীকে বলে দেন তিনি। বিকল্প জটায়ু হিসেবে সব্যসাচী রবি ঘোষের নাম প্রস্তাব করেন। সব্যসাচী এমনকি নিজেও ফেলুদা চরিত্রে অভিনয় করার জন্য আগ্র প্রকাশ করেন সত্যজিৎ রায়ের কাছে। সত্যজিৎ রায় তখন সব্যসাচীকে বলেন সন্দীপ রায়ের সাথে কথা বলতে।
৯৫’এর দিকে ‘ফেলুদা ৩০’ সিরিজে ফেলুদা চরিত্রে অভিনয় করার জন্য সন্দীপ রায়ের কাছ থেকে ডাক পান সব্যসাচী চক্রবর্তী। তাঁর প্রস্তাবেই জটায়ু হিসেবে নেয়া হয় রবি ঘোষকে। শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় কে তপেসের চরিত্রে নিয়ে শুরু হয় সিরিজটা। প্রথম গল্পটা ছিল ‘বাক্স রহস্য’ আর দ্বিতীয়টা ছিল ‘গোসাইপুরে সরগরম’।
মানুষ একটু কথা বলা শুরু করল। প্রথম জটায়ু দুটো ছবি করে মারা যান, দ্বিতীয় জনও দুটো করে মারা গেলেন। এ কেমন কথা?
এবার জটায়ু হিসেবে এলেন অনুপকুমার। জটায়ু ভুমিকায় তিনি ‘বোসপুকুরে খুনখারাপি’ আর ‘যত কান্ড কাঠমুন্ডুতে’ অভিনয় করেন। কিন্তু জটায়ু চরিত্রে অনুপকুমারকে নেয়াটা একটা ভুল সিদ্ধান্ত ছিল সন্দীপ রায়ের। কেউই জটায়ু হিসেবে অনুপকুমারকে মানতে পারলনা না। চারদিক থেকে অনেক আপত্তি। ব্যক্তিগত ভাবে আমি নিজেও জটায়ু হিসেবে অনুপকুমারকে পছন্দ করতে পারিনি।
এবার মানুষ আর থেমে থাকল না। দুটো করার পর পর প্রত্যেক জটায়ু মারা যাচ্ছেন। কী ভূতুড়ে ব্যাপার এটা?
অনেকদিন থেমে ছিল টেলিভিশন সিরিজটা।
এর মধ্যে শুধু ফেলুদা আর তোপশেকে নিয়ে করা হয়ে গেল ‘শেয়াল দেবতা রহস্য’। মূল গল্পেও জটায়ু ছিলেন না, টেলিভিশন সিরিজেও নয়। কারন জটায়ুর প্রথম আগমন সোনার কেল্লা গল্পে। আর শেয়াল দেবতা রহস্য গল্পটা সোনার কেল্লা গল্পের আগের গল্প।
এরপর বিভু ভট্টাচার্যের আগমন জটায়ু হিসেবে। জটায়ুর ভুমিকায় একদম উত্রে গিয়েছিলেন তিনি। আমার মতে জটায়ুর ভুমিকায় সবচেয়ে পারফেক্ট ছিলেন বিভু ভট্টাচার্য। জটায়ু চরিত্রে সন্তোষ দত্তের চেয়েও ভাল করেছিলেন তিনি। রবি ঘোষ আবার একটু কাটখোট্টা ছিলেন জটায়ু চরিত্রের জন্য। অনুপকুমারের কথা বাদই দিলাম। বিভু ভট্টাচার্য শুধু একটা দিক একটু পিছিয়ে ছিলেন যে, তাঁর বয়স গল্পে বর্নিত জটায়ুর চেয়ে বেশি তো ছিলই, বাকী তিনজন জটায়ুর চেয়েও তাঁর বয়স একটু বেশি ছিল।
জটায়ু চরিত্রে অভিনয় করা মানুষগুলো নাকি বেশিদিন বাঁচেনা – এই ধারনাকে ভুল প্রমানিত করে দিয়ে তিনি টেলিভিশন সিরিযে একে একে পাঁচটা গল্পে অভিনয় করেন। অন্যদিকে ফেলুদাকে নিয়ে সন্দীপ রায়ের নির্মিত পাঁচটা চলচিত্রেও অভিনয় করেন। ফেলুদাকে নিয়ে নির্মিত সাতটা চলচিত্রের পাঁচটাতেই জটায়ু হিসেবে তিনি ছিলেন। তাঁর অভিনয় ছিল মোট দশটা গল্পে।
ফেলুদাকে নিয়ে নির্মিত শেষ চলচিত্র ‘রয়েল বেঙ্গল রহস্য’ গল্পে অভিনয় করার পর বিভু ভট্টাচার্যও মারা গেলেন।
এরপর সব্যসাচী চক্রবর্তী সিদ্ধান্ত নেন, তিনি আর অভিনয় করবেন না।
----------------------------------------------------------------------
[সব্যসাচী চক্রবর্তীর দেয়া এক সাক্ষাৎকার থেকে তথ্যগুলো নেয়া]
No comments:
Post a Comment