নাহ...পেলামই না ওর দেখা।
এক সপ্তাহ আগে একদিন বই মেলায় গিয়েছিলাম। সন্ধ্যাবেলায় সোহরাওার্দী উদ্যানে খাদ্যের সন্ধানে দোকানগুলো ঘুরে ফিরে দেখছিলাম। ওই যে, মাশরুম, চিংড়ীর চপ, চিকেন, ডিম চপ, পিঁয়াজু-বেগুনি বিক্রি করে না যেই দোকানগুলোতে? ওখানে।
একটা ব্যতিক্রমী দোকান ছিল – মিষ্টির একটা দোকান। পুডিং, মিষ্টি, রসগোল্লা, রসমলাই, দই, চিড়ে আর কলা –এগুলোই বিক্রি হয় দোকানটায়।
আমি মোটা বলে গ্লুকোজ এড়িয়ে চলি। আর তাই মিষ্টি থেকে নিজেকে তফাতে রাখি। রীতিমত যুঝতে হয় নিজের সাথে। তারপরেও দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আইটেমগুলো দেখছিলাম। কী হবে আর একদিন মিষ্টি খেলে?
চোখ পড়ল পাশে। মাথায় বালু, ছেড়া ফ্রক – একটা তিন/চার বছরের মেয়ে আমার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। উদ্যান কিংবা এর আশেপাশেই যে ও থাকে, সেটা ওর বেশভূষা দেখে সহজেই অনুমান করা যায়। কিন্তু ও আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে কেন?
ও আসলে আমার পাশে দাঁড়িয়ে খুব করুন নয়নে মিষ্টির দোকানের আইটেমগুলো দেখছে... পলকহীন ভাবে দেখছে... পৃথিবীর কোন মানুষের চোখের দৃষ্টি যে এতটা করুন হতে পারে, আমি সেদিনই প্রথম জানলাম ব্যাপারটা।
আমার মধ্যকার পিতৃস্নেহ মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। সহ্য করতে পারলাম না আমি এই দৃশ্য। মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম, ‘মা, তুমি খাবা কিছু?’
এক গাল লাজুক হাসি দিল ও। মাথাটা ডানে কাত করে আবার সোজা করল। হ্যাঁ, ও খাবে। এটাই বলছে সে।
‘কী খাবে?’
লজ্জা যেন ওর কাটছেই না। আঙ্গুল দিয়ে দেখাল কাঁচের ওপরে থাকা এক থালা চিড়েগুলোকে।
কত ছোট্ট ওর চাওয়া! শুধু চিড়ে খাবে ও। কিন্তু শুধু চিড়ে খাইয়ে আমি কোন রকম সুখ পাবনা। ওকে বললাম, ‘শুধু চিড়ে? ভাল লাগবে? দই নেই সাথে?’
এই প্রথম কথা বলল ও, ‘নেন’।
দোকানদারকে বললাম, ‘ভাই, দই চিড়ে বানান তো এক প্লেইট।’
খুব যত্ন নিয়ে এক প্লেইট দই-চিড়ে বানিয়ে আমার হাতে দিল দোকানদার। আমি এক হাতে প্লেইট নিলাম। অন্য হাতে ওকে ধরে চেয়ারে বসলাম।
‘এই নাও। খাও’।
ও খাচ্ছে। মনের সুখ নিয়ে খাচ্ছে। গপ গপ করে গিলছে। আর কোন দিকে না তাকিয়ে প্লেইটের মধ্যে ধ্যান দিয়ে মনোযোগ দিয়ে খাচ্ছে।
আমি ওর দিকে তাকিয়ে ছিলাম। আমার মনে হচ্ছিল, পৃথিবীর আবিষ্কৃত-অনাবিষ্কৃত সবগুলো সুখ ওই মুহুর্তে আল্লাহ আমাকেই দিয়ে দিয়েছিল, পৃথিবীর সবগুলো মানুষের সুখ ওই মুহুর্তে তাদেরকে ছেড়ে আমার কাছে চলে এসেছিল। আর তাই হয়ত, ঠিক ওই মুহুর্তে পৃথিবীর সবাই কিছুক্ষণের জন্য অসুখী হয়ে পড়েছিল। কারন সব সুখ তো তখন আমার কাছে, অন্যেরা তা পাবে কীভাবে? শব্দ করে যে হাসছিলাম সেটা বুঝতে পারছিলাম। চেষ্টা সত্ত্বেও যে থামাতে পারছিলাম না হাসিটা, সেটাও বুঝতে পারছিলাম।
ও হঠাৎ খেতে খেতে আমার দিকে তাকায়। আমি ওকে দেখছি, এটা ও বুঝতে পেরে সে একটা হাসি দেয়।
বোকার মত, একদম স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম ওর এই হাসিটা পেয়ে। মাত্র ৩০ টাকায় কেনা এক প্লেইট দই-চিড়ের বিনিময়ে আমি কি এই হাসিটা পাবার যোগ্য ছিলাম?
ও যে হাসিটা দিয়েছিল না আমার দিকে তাকিয়ে, সেই হাসিটা কেনার জন্য বিল গেইটস তার সব সম্পদ দিয়ে দিতে রাজী হত।
সিদ্ধান্ত নিলাম। আজ ওকে আমি সব খাইয়ে দিব... চারপাশে দোকান গুলোতে যা আছে...সব।
পাগলের মত তাই মানিব্যাগ খুলে টাকা দেখতে লাগলাম। অনেকগুলো বই কিনে ফেলার কারনে টাকা নেই হয়ে গিয়েছে অনেক আগেই। ডেবিট কার্ডটাও এক এটিএম বুথের ম্যাশিনে পড়ে আছে কদিন ধরে। সাথে যা আছে তা শুধু বাড়ি ফেরার ভাড়া আর ওই দই-চিড়ের যা দাম।
আর সামলাতে পারছিলাম না নিজেকে। ওর সামনে থেকে আমার চলে যাওয়া উচিত, সেটা বুঝতে পারছিলাম। নাহলে কোন পাগলামি করে বসি, সেটার কোন ঠিক নেই। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম, ‘মা, তুমি খাও? আমি যাই?’
আমাকে বলল, ‘পানি খাব আমি।’
দোকানদারের কাছে পানি চাইলাম।
‘মামা পানি ১৫ টাকা।’
সাথে পানির একটা বোতল ছিল। ওটা ওকে দিয়ে দেই। পানি ছিলই না। একটুখানি পানি ছিল। সেটাই ও খাচ্ছে।
দোকানদারের দাম চুকিয়ে পেছনে না ফিরে একদম হাঁটা দিলাম বের হয়ে যাওয়ার জন্য।
রিকাশায় বসে আর কিছুই ভাবতে পারছিলাম না। চোখে ভাসছিল ওর সেই হাসিটা। ৩০ টাকা দিয়ে এত বড় একটা জিনিষ পেতে পারি, ভাবিনি।
একটা সপ্তাহ অফিসে কাজ করেও ভুলতে পারিনি ওকে।
...দই-চিড়ে পেয়ে ওর চোখে মুখে আনন্দের যেই ছটা দেখেছিলাম...কোন কিছুর তুলনা হতে পারে কি এর সাথে?
না...পারেনা।
আজ বিকেলে আবার গিয়েছিলাম বই মেলায়। আবার গিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছিলাম মিষ্টি ওয়ালার সেই দোকানের সামনে। ৩ টা থেকে ৪ টা... ৬ টা থেকে ৭ টা...
কিন্তু নাহ...আর পেলাম না ওর দেখা।
No comments:
Post a Comment