মৃতের জন্য মাতম করা চীনে শৈল্পিক পর্যায়ের। কেউ মারা গেলে তার জন্য মাতম করতে এই কাজে দক্ষ অভিনেত্রীদের ভাড়া করে মৃতের পরিবার। প্রফেশনাল এসব ব্যক্তিদের বলা হয় Paid Mourners। তাদের সাথে ঘণ্টা ভিত্তিক চুক্তি করে পরিবারগুলো। মৃত ব্যক্তির কর্মজীবন আর ব্যক্তিজীবন সম্পর্কে তাদেরকে কিছু তথ্য জানিয়ে দেয়া হয় যেন শেষকৃত্যে আসা সব মানুষের সাথেই কথা চালিয়ে যেতে পারে তারা। বাকী কাজ তাদের। ঘণ্টা হিসেব করে কাঁদবে তারা। সে কান্না ভারী গগনবিদারী। গলা ছেড়ে বলবে আজ কী যেন হারিয়ে গেছে তাদের, বেঁচে থাকার কোন অর্থই নেই আর। তা দেখে শেষকৃত্যে আসা স্বল্প পরিচিত মানুষগুলো খুব ঈর্ষা করবে মৃত ব্যক্তিকে – আহা, কতইনা ভালবাসা দিয়েছিলেন ভদ্রলোক পরিবারের এই মানুষগুলোকে।
তবে পরিবারের ‘আসল’ সদস্যরা নিজেদের কাজে ব্যস্ত থাকে তখন।
সে যাই হোক। আমার মূল কথায় আসি।
টিভির সংবাদের প্রায়ই দেখি দেশে হত্য, দুর্ঘটনা বা অন্য কোন কারনে কেউ মারা গিয়েছে আর তার জন্য পরিবারের সদস্যরা মিলে মাতম করছে। সেটা দেখেই এই লেখাটা লেখার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলাম।
মৃতের জন্য মাতম করার শারঈ হুকুম হল – এটা হারাম। যার জন্য মাতম করা হয় কবরে তারও আযাব হয়, যারা মাতম করবে তাদের মৃত্যু তওবাবিহীন হলে তাদেরকে হাশরের মাঠে খুব আযাবের সাথে দণ্ডায়মান করা হবে।
মৃতব্যক্তির জন্য মাতম করা অনুচিত সে ব্যাপারে উমার বিন খাত্তাব রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্নিত,
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “মৃতব্যক্তির জন্য মাতম করার ফলে তাকে কবরে আযাব দেয়া হয়।”
[বুখারী ১২৯২, মুসলিম ৯২৭, ইবন মাজাহ ১৫৯৩ নং, নাসাঈ]
এই হাদিসের ব্যাখ্যায় মুহাদ্দিসগণ বলেন যে, কোন ব্যক্তি তার মৃত্যুর পুর্বে পরিবারবর্গকে মাতম করার জন্য বলে গেলে বা মাতম করা থেকে বিরত না থাকার জন্য বলে গেলে এবং এর ফলে তার পরিবারবর্গ মাতম করলে তার কবরে আযাব হবে। কাজেই প্রত্যেক ব্যক্তির নিজের পরিবারবর্গকে এটা অসিয়ত করে যাওয়া আবশ্যক যেন তার মৃত্যুর পর পরিবারের কেউ মাতম না করে।
জাহেলি যুগের সব কাজই কিন্তু কুফর নয়। কিন্তু মৃতের জন্য মাতম করা এমন একটা কাজ যেটা জাহেলি যুগের সংস্কৃতি আবার একই সাথে কুফরও বটে।
আবূ মালেক আশআরী রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্নিত এক হাদিস থেকে জানা যায় যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “আমার উম্মতের মাঝে চারটি কাজ হল জাহেলিয়াতের প্রথা যা তারা ত্যাগ করবেনা।”
এর অর্থ, জাহেলিয়াতের কিছু প্রথা উম্মতের মধ্যে এমনভাবে ছেয়ে যাবে যে সেগুলো এই উম্মত কখনো বর্জন করতে পারবেনা। সেই চারটি কাজ হলঃ বংশ নিয়ে গৌরব করা, বংশ সুত্রে খোঁটা দেওয়া, তারা-নক্ষত্রের মাধ্যমে বৃষ্টির আশা করা এবং মৃতের জন্য মাতম করা।
মাতম করা যে কুফফারদের কাজ সেই প্রসঙ্গে আবু হুরাইরা রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্নিত,
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “মানুষের মাঝে দুটো কাজ এমন রয়েছে যা কুফর; বংশে খোঁটা দেওয়া আর মৃতের জন্য মাতম করা।”
[মুসলিম ৬৭নং]
যারা মাতম করবে তাদের শাস্তির ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “মাতমকারিণী মহিলা যদি মৃত্যুর পুর্বে তওবা না করে মারা যায় তাহলে কিয়ামতের দিনে তাকে গলিত (উত্তপ্ত) তামার পায়জামা ও চুলকানিদার (অথবা জাহান্নামের আগুনের তৈরি) কামিয পরিহিত অবস্থায় পুনুরুত্থিত করা হবে।”
[মুসলিম ৯৩৪, ইবনে মাজাহ]
এখন যাদের মনে প্রশ্ন জাগছে, “তবে কি নিকট আত্মীয়ের মৃত্যুতে আমরা কাঁদতে পারবোনা?” তাদের বলছি।
হ্যাঁ অবশ্যই কাঁদতে পারবেন। কান্নাকাটি করা আর মাতম করা এক কথা নয়। কান্নাকাটি শ্রেফ অশ্রু বিসর্জন; মাতম অর্থ চিৎকার চেঁচামিচি করে বিলাপ করা।
কোন নিকটাত্মীয়ের মৃত্যুতে দুঃখে ভারাক্রান্ত হওয়া, কান্নাকাটি করা - জায়েয বিষয়; যদি এটি প্রকৃতিগত হয়ে থাকে; এর সাথে চিৎকার, চেচামেচি অথবা আল্লাহর প্রতি অসন্তুষ্টি প্রকাশ না পায়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে তাঁর ছেলে ইব্রাহিমের মৃত্যুতে কেঁদেছেন। তিনি বলেছেন, “চক্ষু অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে, মন ভারাক্রান্ত। তবে আমরা শুধু সেটাই উচ্চারণ করব যা আমাদের প্রতিপালককে সন্তুষ্ট করে। ইব্রাহিম! তোমার মৃত্যুতে আমরা দুঃখে ভারাক্রান্ত।”
[বুখারি ১২২০ ও সহিহ মুসলিম ৪২৭৯]
শুধু মৃত ব্যক্তির জন্যই মাতম করা হারাম এমনটা নয়। যে কোন অবস্থাতেই মাতম করা হারাম; হোক সেটা দুর্ভাগ্য দেখে বা দুর্যোগের শিকার হয়ে।
ইবনে মাসঊদ রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্নিত,
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “সে ব্যক্তি আমার দল্ভুক্ত নয় যে ব্যক্তি (বিপদে অধৈর্য হয়ে অথবা লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে) গালে চাপড় মারে গলা ও বুকের কাপড় ফাড়ে এবং জাহেলী যুগের মানুষদের মত ডাক ছেড়ে মাতম করে।”
[বুখারী ১২৯৪, ২১৯৭, মুসলিম ১০৩, তিরমিযী, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ ১৫৮৪ নং, আহমদ, ইবনে হিব্বান]
আমাদের পরিবারের মা-দাদী-নানী-খালা শ্রেণীয়া নরম মনের মানুষগুলো খুব মাতম করে মৃতের জন্য। এবং অবশ্যই না জানার কারনে তারা নিজেদেরকে মাতম করা থেকে সামলিয়ে রাখতে পারেন না। কিন্তু ভেবে দেখুন একবার, তাঁদের মাতমের জন্য তাঁদের প্রিয় মানুষটাও কবরে আযাব পাচ্ছে – এটা জানার পরেও মাতম করবেন তারা? কখনোই নয়। আমাদের কাজ হল তাঁদেরকে এই ব্যাপারটা জানিয়ে দেয়া।
আর অশ্রু বিসর্জন দিয়ে শোক প্রকাশ বৈধ মানে এটাও নয় যে দীর্ঘদিন যাবত মন খারাপ করে রেখে দিব। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নারীকে মৃতব্যক্তির জন্য তিনদিনের অধিক সময় শোক প্রকাশ করতে বারণ করেছেন। তিনি বলেন, “মৃত্যব্যক্তির জন্য তিনদিনের বেশি শোক করা আল্লাহ ও পরকালের উপর ঈমানদার নারীর জন্য নাজায়েয। তবে নারী তার স্বামীর জন্য ৪ মাস ১০ দিন শোক পালন করবে।”
[বুখারী ১২৮০ ও সহিহ মুসলিম ১৪৮৬]
আল্লাহু আলাম।
আল্লাহ সুবহান ওয়া তাআলা আমাদেরকে, আমাদের প্রিয় মানুষদেরকে মৃত্যু পরবর্তী যাবতীয় আযাব থেকে মুক্তি দেয়ার ফয়সালা করে দেন। আমীন।
No comments:
Post a Comment